
বগুড়া সরকারী আযিযুল হক কলেজে একসময় আমি বাংলা বিভাগে লেকচারার পদে যোগ দিয়েছিলাম। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা এতোটা উন্নত ছিলনা। যশোর থেকে ট্রেইনে এরপর বাসে যোগে বগুড়া জেলা শহর। আমি দূরবর্তী দুর্গম এলাকার মানুষ হিসেবে সহকর্মীদের কাছে বিবেচিত হতাম।
একদিন সমবয়সী কয়েকজন সহকর্মী প্রস্তাব দিলো সন্ধ্যায় বাজারে যেতে হবে। গুড় পাটালির দোকানে যশোরের উন্নতমানের পাটালি পাওয়া যায়। যশোরের পাটালি আর বগুড়ার মুড়ি দিয়ে সান্ধ্য উৎসব পালিত হবে। যাদের সাথে গেলাম; একজন নিজামউদ্দিন, অন্যজন ফারুক আহমেদ। কালীতলা বাজার একদিকে কালী মন্দির আর অল্প দূরত্বে রয়েছে একটি মসজিদ। মাঝখানে বাজারের একটি অংশে গুড় পাটালি। দশবারোবি গুড় পাঠালির দোকান। মনে হলো, হিন্দু-মুসলিম গুড়ের বন্ধনে এখানে আবদ্ধ রয়েছে। সহকর্মীদের দুই একটি পরিচিত দোকান। আমাদের দেখে খুব ডাকাডাকি শুরু করলো। স্বল্প দূরত্বে মন্দির আর মসজিদ। উন্নতমানের পাটালি, যশোরের পাটালি, বাংলাদেশের বিখ্যাত পাটালি। তারা খুব কোলাহল করে উঠলো। কাছের একটি দোকানে আমরা পৌঁছলাম। সহকর্মী নিযামউদ্দিন দোকানদারকে বললেন আমাকে দেখিয়ে:
: ইনাকে চিনো।
: না স্যার। উনাকে তো আমরা চিনবার পাইল্লাম না।
: দেখতো খেয়াল করে।
চেষ্ঠা করলো কিন্তু আমাকে চিনতে পারলো না। তারা যশোরের লোক চিনতে না পারলেও যশোরের পাটালি খুব চিনতে পারে। সহকর্মীরা আমার পরিচয় দিয়ে বললেন:
: উনি যশোরের মানুষ। যশোর থেকে এসেছেন। আযিযুল হক কলেজে যোগ দিয়েছেন। দোকানদাররা সবাই নির্বাক, নিশ্চুপ হয়ে গেল। আমি কৌতুহলি হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
: এগুলো যশোরের কোন এলাকার পাটালি। আপনারা অনেক কষ্ট করে দূর থেকে পাটালি নিয়ে এসেছেন। দোকানদাররা কেমন অপ্রস্তুতবোধ করতে থাকলো। একজন বিক্রেতা সবিনয়ে বললো;
: স্যার। পাটালি আসলে যশোরের থেকে আসেনি। যশোরের কথা বললে বিক্রিটা খুব ভালো হয়। যশোরের পাটালির অনেক চাহিদা।
যশোরের খেজুর গুড় আর পাটালি ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে। যশোর ছাড়াও বাংলাদেশের অনেক জেলাতে খেজুরের রস, গুড়, পাটালি উৎপন্ন হয়ে থাকে। বগুড়া, রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, খুলনা, নড়াইল, ঝিনাইদহ, মাগুরা, মাদারিপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ অঞ্চলে খেজুর রসের ও গুড় পাটালির উৎপাদন চলছে ব্যাপক ভাবে। তবে আগের মত কোনো জেলাতেই আর হচ্ছে না।
ছেলেবেলাতে শীতের একটি বিশেষ আনন্দ ছিল সকালে খেজুরের রস। শীতের প্ররম্ভে নতুন রস, গুড় আর চিনির বিশেষ ঘ্রাণ ছিল। তাকে বলা হতো নলেন পাটালি।
প্রতিদিন সকালে খেজুরের রস আর মচমচে মুড়ি। রস মুড়ি আর নলেন পাটালির স্বাদ এখন আর পাওয়া যায় না। তবে তা ভোলাও যায় না।
নলেন গুড় পাটালি আত্মীয় বাড়ি পাঠানোর একটা রেওয়াজ ছিল। বাড়িতে এলে আত্মীয় স্বজনকে পরিবেশন করা হতো কাচা রসের ক্ষীর। পল্লীগীতির অবিস্মরণীয় শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠের গান মনে পড়ে: “কৈ গেলিলো লো ট্যানার মা কাচা রসের ক্ষীর পাকাইলাম খাইয়া গেলিনা।”
খেজুরের গুড়, পাটালির বিখ্যাত বিক্রয় কেন্দ্র ছিল যশোর জেলার খাজুরা বাজার। ছাতিয়ানতলার হাট, মণিরামপুর এবং কেশবপুর বাজার। গ্রামের কৃষিজীবীদের প্রায় প্রতিটি সংসারেই খেজুরের গুড় পাটালির তৈরির ব্যবস্থা ছিল। ছাতিয়ানতলায় সপ্তাহে দুইবার হাট বসতো, বৃহস্পতিবার আর রবিবার। এই দুটি দিন ছিল উৎসবের মতো। অনেক কৃষিজীবী গরুর গাড়িতে গুড়, পাটালি, কলাই, মুসুরি বোঝাই করে নিয়ে যেতো ছাতিয়ানতলার হাটে।
বিক্রির পর বড় আকৃতির মাছ, খাসির গোশতো, তাজা তরকারি এবং মিষ্টির হাড়ি ক্রয় করা হবে। রান্নার ঘ্রাণে আর ভোজনরসিকদের আনন্দ কোলাহলে মুখরিত চারদিক। পরিতৃপ্তির আহার শেষে আবার গরুর পরিবহনে তাদের ঘরে ফেরা। অনেকের কণ্ঠে ধ্বণিত হতো আব্বাস উদ্দিনের সুর সুধা: “ও কি গাড়িয়াল ভাই কত রবো আর পন্থের দিকে চাইয়া।” এইসব আনন্দধ্বণি স্মৃতির পাতায় গুঞ্জন তোলে, জীবনে তা আর নেই।
খেজুরের রস জ্বালানোর পর গুড়ে ফোট ধরে। তারপর জাতি দিয়ে ঘসে ঘসে বিজ মারার পর বড় আকৃতির মাটির নান্দায় ঢেলে দেয়া হতো। তারপর গুড় জমে দানা তৈরি হলে নান্দার উপরে পাটা শেওলা দিয়ে তলা ফুটো করে দিলে তরল গুড় নিচের পাত্রে ঝরে যেতো নান্দায় জমে থাকতো চিনি। কেশবপুর, মনিরামপুর, রাজগঞ্জ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে খেজুর চিনি তৈরি হতো। মনিরামপুর থেকে সড়কপথে পাঁচ মাইল দূরে রয়েছে একটি বাজার: চিনি টৌলা বাজার। খেজুর চিনি থেকে এই নামকরণটি হয়েছে। এখন চিনি টৌলা বাজার রয়েছে চিনি নেই।
কৃষি নির্ভর গ্রামীণ জীবনের প্রতিদিন সকালের নাস্তা ছিল পান্থাভাত, খেজুরের গুড়, চিনি তার সাথে নারকেল কোরা। বৈশাখি উৎসবে পান্থা ইলিশের বদলে পান্তা, গুড় আর নারকেল পরিবেশিত হওয়া উচিত। খেজুর চিনি উৎপাদনের বিষয়াদি বাংলাদেশ সরকারের কৃষি বিভাগ ভেবে দেখতে পারে।